চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শুরুটা প্রত্যাশামতো হয়নি বাংলাদেশের। দুবাইয়ে বৃহস্পতিবার নিজেদের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ৬ উইকেটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছে শান্তর নেতৃত্বাধীন দল। পুরো ম্যাচে দলের একমাত্র প্রাপ্তি ছিল তাওহিদ হৃদয়ের দারুণ সেঞ্চুরি ও জাকের আলীর সঙ্গে তার রেকর্ড জুটি, যা কিছুটা লড়াইয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল টাইগারদের।
বাংলাদেশের ব্যাটিং সমস্যা যেন এক স্থায়ী রূপ নিয়েছে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। টপ অর্ডারের ব্যর্থতায় শুরুতেই বড় ধাক্কা খেয়েছে টাইগাররা, মাত্র ৩৫ রানের মধ্যেই ফিরে গেছেন পাঁচজন ব্যাটার। তবে সেই ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে একাই দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে যান তাওহিদ হৃদয়। তার অসাধারণ সেঞ্চুরিতেই দল লড়াই করার মতো একটা স্কোর গড়তে সক্ষম হয়। এরপর বোলাররা প্রাণপণ চেষ্টা করলেও শেষ হাসিটা হাসে ভারত।
দুবাইয়ে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামে বাংলাদেশ, কিন্তু শুরুতেই বিপর্যয়। ৪৯.৪ ওভারে সবকটি উইকেট হারিয়ে সংগ্রহ করে ২২৮ রান। দলের হয়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন তাওহিদ হৃদয়, যিনি ১০০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছেন। তার সঙ্গে কিছুটা অবদান রাখেন জাকের আলি, যিনি ৬৮ রান করেন। ভারতের হয়ে মোহাম্মদ শামি ছিলেন ভয়ঙ্কর, মাত্র ৫৩ রান দিয়ে শিকার করেন ৫টি উইকেট। জয়ের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ভারত শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে এবং ৪৬.৩ ওভারে মাত্র ৪ উইকেট হারিয়েই জয় নিশ্চিত করে।
ইনিংসের প্রথম ওভারেই দুঃস্বপ্নের শুরু, সৌম্য সরকার ৫ বল খেলে কোনো রান না করেই বিদায় নেন। শামির একটি অফ-স্টাম্পের বাইরের বল ড্রাইভ করতে গিয়ে ব্যাটের ভেতরের কানায় লাগিয়ে ক্যাচ দেন রাহুলের গ্লাভসে। পরের ওভারেই আরও বড় ধাক্কা, অধিনায়ক শান্ত কোনো রান না করেই সাজঘরে ফেরেন হারষিত রানার বল কাট করতে গিয়ে কোহলির হাতে ক্যাচ দিয়ে।
দুই ওভারেই দুই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে বাংলাদেশ। তানজিদ হাসান তামিম কিছুটা সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু চার নম্বরে নামা মেহেদি হাসান মিরাজও সুবিধা করতে পারেননি। অফ-স্টাম্পের বাইরের বল কাট করতে গিয়ে স্লিপে গিলের হাতে ধরা পড়েন তিনি। দলীয় ২৫ রানের মাথায় আরও একটি আঘাত, এবার তামিমও ফিরে যান রাহুলের হাতে ক্যাচ দিয়ে।
মুশফিকুর রহিমের ওপর অনেক আশা ছিল, কিন্তু প্রথম বলেই তিনি ডিফেন্স করতে গিয়ে ব্যাটের কানা ছুঁইয়ে ক্যাচ তুলে দেন। প্রথম পাঁচ ব্যাটারের চারজনই কোনো রান না করেই ফিরেছেন! এমন বিপর্যয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে নেমে আসেন তাওহিদ হৃদয় ও জাকের আলি।
৩৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে একদম খাদের কিনারায় চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সেখান থেকে দলকে টেনে তোলেন তাওহিদ হৃদয় ও জাকের আলি। দুজনে মিলে ধীরে ধীরে রান তুলতে থাকেন, রক্ষণাত্মক শুরু করলেও একসময় হাত খোলেন হৃদয়। একদিকে তিনি আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করছিলেন, অন্যদিকে জাকের ছিলেন ধৈর্যশীল।
এই দুজনের ব্যাটে ভর করেই বাংলাদেশ বড় ধসের মুখ থেকে ফিরে আসে। ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে তারা ১৫৪ রান যোগ করেন, যা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে ষষ্ঠ উইকেটের জন্য সর্বোচ্চ জুটি। এছাড়াও, ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসে এটি ষষ্ঠ উইকেটে সর্বোচ্চ রান।
জাকের ৬৮ রান করে ফিরলে ভেঙে যায় এই জুটি। তবে হৃদয় লড়াই চালিয়ে যান। শেষদিকে রিশাদ হোসেন ১২ বলে ১৮ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেন, কিন্তু সেটি খুব বেশি কাজে আসেনি।
তাওহিদ হৃদয় শেষপর্যন্ত ব্যথা নিয়েই ব্যাটিং করে যান এবং চমৎকার এক সেঞ্চুরি তুলে নেন। তবে তাকে যথেষ্ট সঙ্গ দিতে পারেননি কেউ। ১১৮ বলে ১০০ রান করে শেষ ওভারে বিদায় নেন তিনি, আর বাংলাদেশ গুটিয়ে যায় ২২৮ রানে।
বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের মতো বোলিংয়ের শুরুটাও ছিল হতাশাজনক। তাসকিন আহমেদ ও মুস্তাফিজুর রহমানের নতুন বলে কোনো ধার ছিল না। তাদের ওপর চড়াও হন রোহিত শর্মা ও শুবমান গিল। প্রথম ৮ ওভারেই ভারত তুলে ফেলে দলীয় পঞ্চাশ।
অবশেষে দশম ওভারে তাসকিনের বোলিংয়ে রিশাদের দুর্দান্ত ক্যাচে রোহিত শর্মা ফেরেন। এরপর রিশাদ-মিরাজের স্পিন আক্রমণে কিছুটা ম্যাচে ফেরার ইঙ্গিত দেয় বাংলাদেশ। কোহলি বেশ দেখে-শুনে খেলছিলেন, কিন্তু থিতু হয়েও বেশি দূর যেতে পারেননি। ২৩তম ওভারে রিশাদের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ২২ রানে বিদায় নেন তিনি।
আরও পড়ুনঃ-চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির উদ্বোধনী ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ
শ্রেয়াস আইয়ারকে মুস্তাফিজ ফিরিয়ে দিলে কিছুটা আশার সঞ্চার হয় টাইগার শিবিরে। এরপর ভারতের টিম ম্যানেজমেন্ট পরিকল্পনা বদলে অক্ষর প্যাটেলকে পাঠায় দ্রুত রান তোলার জন্য। কিন্তু রিশাদ হোসেনের ঘূর্ণিতে তার সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। মাত্র ৮ রান করে রিশাদকে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন অক্ষর।
এই সময়ে ম্যাচ কিছুটা হাড্ডাহাড্ডি হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে হতাশার মুহূর্ত আসে লোকেশ রাহুলের ক্যাচ মিসের ঘটনায়। তখন তিনি মাত্র ১০ রানে ছিলেন, সহজ ক্যাচ দিয়েছিলেন জাকেরের হাতে, কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি তিনি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকায়নি ভারত।
শেষদিকে শুবমান গিল ও লোকেশ রাহুল দায়িত্বশীল ব্যাটিং করেন। ৮৭ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে জয় নিশ্চিত করেন তারা। গিল ১২৯ বলে ১০১ রানে অপরাজিত থাকেন, আর রাহুল ৪১ রানে অপরাজিত থাকেন।
বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে ভালো বোলিং করেছেন রিশাদ হোসেন, ৩৮ রানে ২ উইকেট নিয়েছেন তিনি। এছাড়া তাসকিন ও মুস্তাফিজ একটি করে উইকেট শিকার করেন।
তবে দিনের নায়ক ছিলেন তাওহিদ হৃদয়, যিনি একাই লড়াই চালিয়ে গেছেন। কিন্তু তার শতরানও শেষ পর্যন্ত দলকে জেতানোর জন্য যথেষ্ট হয়নি। বাংলাদেশের জন্য এটি আরেকটি শিক্ষা হয়ে থাকল— শুধু একজনের লড়াই দিয়ে ম্যাচ জেতা সম্ভব নয়, দলগত পারফরম্যান্স ছাড়া জয়ের আশা করাও ভুল।
ডেস্ক রিপোর্টার
সর্বাধিক পঠিত
Loading...